কক্সবাজারের চকরিয়ার উপকূলীয় চিংড়ি জোনের কয়েক হাজার চিংড়ি চাষি এখনো জিম্মি অবস্থায় রয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে। রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়–প্রশ্রয়ে থাকা অন্তত শতাধিক চিহ্নিত ও দাগি সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ডাকাতের দাবি অনুযায়ী প্রতিনিয়ত বখরা (চাঁদা) দিয়ে চিংড়ি উৎপাদন করতে হচ্ছে চাষিদের।
এমনকি সরকারিভাবে ১০ একর করে লিজপ্রাপ্তরাসহ এসব চাষিকে প্রতি জোঁ–তে (চিংড়ি ধরার মৌসুম) রাজনৈতিক চেলাচামুণ্ডদের কাছে পৌঁছে দিতে হয় এক হাজার টাকা করে। এভাবে চাঁদাবাজ–সন্ত্রাসী–ডাকাত অর্থাৎ দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণেই চলে গেছে পুরো চিংড়িজোন। এতে পুরো চিংড়ি জোনের ৪৫ হাজার ৫৩০ দশমিক ৭০৮ একর চিংড়ি উৎপাদনের জমি একেবারেই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
এসব কিছুর পরেও শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এই পরিমাণ জমি থেকে চাষিরা প্রতিবছর ৩৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার চিংড়ি ছাড়াও শতকোটি টাকার অন্য প্রজাতির মাছ উৎপাদন করছেন। আবার চিংড়ি উৎপাদন মৌসুম আসলেই নতুন করে চিন্তায় থাকতে হয় দখল–বেদখলের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায়। এসব কারণে চিংড়িসহ মৎস্য উৎপাদনে জড়িত বেশিরভাগ চাষি বিনিয়োগকৃত পুঁজি পুষিয়ে নিতে ব্যর্থও হচ্ছে। তাই এসব কিছু থেকে পরিত্রাণ দিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হাজারো চিংড়ি চাষিরা আইন–শৃঙক্ষলা বাহিনীসহ সরকারের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অবশ্য চকরিয়া থানা পুলিশ গত একমাসের মধ্যে চিংড়িজোনসহ আশপাশের এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান জোরদার করে অন্তত ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কয়েকজন চিহ্নিত ও দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দারকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে। তন্মধ্যে ডুলাহাজারার আলোচিত ছরওয়ার ডাকাত, সাহারবিলের নুরুল আলম বদাইয়া ও কাইছার অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কক্সবাজার বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়ার সুন্দরবন রেঞ্জের এই পরিমাণ জমিতে এক সময় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (প্যারাবন) থাকলেও ১৯৭৮ সাল থেকে বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় চকরিয়া সুন্দরবনে চিংড়ি চাষের গোড়াপত্তন শুরু হয়। এর পর পর্যায়ক্রমে এসব প্যারাবন নিধন হতে হতে বর্তমানে প্যারাবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। অবশ্য কাগজে–কলমে বনবিভাগের রেকর্ডে চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ (সি.এস রেঞ্জ) হিসেবে বিদ্যমান থাকলেও কার্যত বনভূমি বলতে কিছুই নেই, আছে শুধু চিংড়িঘের। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় মাত্র ৩৯ জন ভাগ্যবান ধনাঢ্য ব্যক্তির নামে বিশাল চিংড়ি ভূমি লিজ দিয়ে চিংড়ি চাষের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এর পর সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে সামরিক অধ্যাদেশ মূলে ৩৯ জন ধনাঢ্য ব্যক্তির নামে দেওয়া লিজ বাতিল করে ১০, ১১ ও ৩০ একর বিশিষ্ট ঘের করে সর্বসাধারণকে চিংড়ি চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি লিজ দেয়া হয়। এভাবে চিংড়ি চাষের ধারা অব্যাহত থাকলেও বর্তমানে আগের সেই চিত্র নেই বলা চলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিংড়ি চাষি বলেন, ‘চিংড়ি ঘেরে মাসে দুইবার মাছ ধরা হয়। যাকে চাষিরা স্থানীয় ভাষায় (জোঁ) হিসেবে বলে থাকেন। প্রতি জোঁ’তে ১০ একর ঘেরের জন্য এক হাজার টাকা ২০ একরের জন্য দুই হাজার টাকা ৩০ একরের জন্য তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয় সন্ত্রাসীদের। সন্ত্রাসীরা এই চাঁদাকে অবশ্য ‘জিজিয়াকর’ হিসেবে দাবি করেন। তাদের নির্ধারিত পরিমাণ এই চাঁদা যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে জোঁ’তে পাওয়া মাছগুলো লুট করে নিয়ে যায় চোখের পলকে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার কোন উপায় তারা রাখে না।
চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান জানান, চকরিয়া উপজেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় সর্বমোট ৩ হাজার ৫৮টি চিংড়ি ঘের রয়েছে। তন্মধ্যে খুটাখালীতে ২৫০টি, ডুলাহাজারায় ৯৫টি, সাহারবিলে ৫০৪টি, চিরিংগায় ১ হাজার ১০৫টি, কোনাখালীতে ৭০টি, বদরখালীতে ২০২টি, পশ্চিম বড় ভেওলায় ২০০টি, ঢেমুশিয়া ইউনিয়নে ৪৫টি ঘেরের অবস্থান। এসব ইউনিয়নের ঘেরের মধ্যে চিংড়ি জমির পরিমাণ রয়েছে ৪৫ হাজার ৫৩০ একর। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় রয়েছে ৫৮৭টি। সেখানে ৪৮ একরের একটি চিংড়ি প্রদর্শনী খামারও রয়েছে।
মৎস্য বিভাগের হিসেব মতে, প্রতিবছর এই পরিমাণ জমিতে চিংড়ি উৎপাদন হয় ৩৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার। এছাড়াও শতকোটি টাকার অন্যান্য প্রজাতির মাছও উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু চিংড়ি জোন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চকরিয়ার চিংড়ি জোনের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীনও প্রায় সাত হাজার একর চিংড়ি জমি রয়েছে। এসব জমি এখনো রাজনৈতিক ও দখলবাজ ভূমিদস্যুদের কবলে থাকায় সরকারের পকেটে এক টাকাও রাজস্ব হিসেবে জমা পড়ছে না।
অবশ্য স্থানীয় সূত্র জানায়, ভূমি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের এসব চিংড়ি জমির দখল–বেদখল নিয়ে প্রতিনিয়ত সংঘাত–সংঘর্ষ চলেই আসছে। মূলত এই পরিমাণ জমি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে যায়।
চকরিয়ার বৃহৎ চিংড়ি চাষি ও উপজেলা বিত্তহীন সমবায় সমিতির (বিআরডিবি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম উল্লাহ দাবি করেন, চিংড়ি ঘের এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই সেকেলে। এই অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সশস্ত্র চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও ডাকাতেরা বিনা বাধায় লুটপাট, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘চিংড়ি জোনে এসব অপরাধ কর্মে অগ্রভাগে রয়েছে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনা ও পালাকাটা, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন, খুটাখালী ইউনিয়ন ও সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর ও কোরালখালীর অন্তত দেড় শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীরা সরকার দলের অসংখ্য নেতার আশ্রয়–প্রশ্রয়ে থেকে এসব অপকর্ম করছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার–১ আসনের এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, চকরিয়ার উপকূল থেকে চিংড়ি ও মৎস্য খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় চিংড়ি চাষিদের অর্জন ম্লান হচ্ছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও চাষিরা চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মৎস্য উৎপাদন করছে। সন্ত্রাসীদের নির্যাতন ও চাঁদাবাজি থেকে নিরীহ চাষিদের রক্ষায় আইন–শৃঙক্ষলা বাহিনীকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘আমি এই পর্যন্ত জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত আইন–শৃঙক্ষলা সংক্রান্ত অসংখ্য সভায় বলেছি, প্রকৃত চিংড়ি চাষিদের বাদ দিয়ে বহিরাগতদের এখানকার চিংড়ি জমি লিজ দেয়ায় চিংড়ি জোনের একমাত্র সমস্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই প্রকৃতপক্ষে যারা চিংড়ি চাষি নন তাদের নামে দেয়া লিজ বাতিল করে পুনরায় চিংড়ি চাষিদের নামে বরাদ্দ দেয়া হলে চাঁদাবাজি–ডাকাতির মতো ঘটনা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এর পরেও চিংড়িজোনে চাষিরা যাতে নির্বিঘ্নে চিংড়িসহ মৎস্য উৎপাদন করতে পারে সেজন্য সকল ধরণের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চকরিয়ার চিংড়ি জোনের অবস্থা আগে থেকেই তেমন ভাল ছিল না। এর পরেও আমি এই থানায় যোগদান করার পর থেকে একের পর এক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছি চিংড়িজোনসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিসহ কয়েকজন চিহ্নিত ও দাগি দুর্ধর্ষ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
ওসি আরো বলেন, ‘বিশাল চিংড়ি জোন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভাল নয়। কোন ঘটনার সংবাদ শোনামাত্রই সহসা ঘটনাস্থলে পৌঁছুতে পারি না। তাছাড়াও অন্যপন্থায় সেখানে পৌঁছার আগেই অপরাধীরা নৌ–পথে পালিয়ে যায়। চিংড়ি জোনের নিরাপত্তায় রামপুর পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও ঘের এলাকায় তাৎক্ষণিক অভিযান চালানোর জন্য কোন ধরণের নৌ–যানও নেই। এর পরেও শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। ইতিমধ্যে ঘের এলাকার ত্রাস কোরালখালীর লুৎফুর রহমানসহ অসংখ্য ঘের ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য যেসব সন্ত্রাসী–ডাকাত ঘেরে তাণ্ডব চালানোর মতো অবস্থায় রয়েছে তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।’
পাঠকের মতামত: